জাডেজা-সুন্দরেরও শতরান, সসম্মানে ম্যাচ বাঁচাল ভারত, ম্যাঞ্চেস্টারে ইংল্যান্ডের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে সিরিজ়ে টিকে শুভমনেরা
ড্র হয়ে গেল ম্যাঞ্চেস্টার টেস্ট। পঞ্চম দিনের খেলা নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে গেল। এই ম্যাচ জিততে পারবে না ভেবে আগেভাগেই ড্র করতে রাজি হয়ে গেল ইংল্যান্ড। ভারত সিরিজ়ে পিছিয়ে থাকল ১-২ ব্যবধানে।
ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসের বয়স তখন ১৩৮ ওভার। স্কোর ৩৮৬-৪। ক্রিজ়ে ছিলেন ওয়াশিংটন সুন্দর (৮০) এবং রবীন্দ্র জাডেজা (৮৯)। তখনও ম্যাচ শেষ হতে প্রায় দেড় ঘণ্টা বাকি। হঠাৎই জাডেজার দিকে এগিয়ে এসে হাত মেলাতে গেলেন বেন স্টোকস। প্রস্তাব দিলেন ড্র করার। ভারতের দুই ব্যাটার সসম্মানে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। জানালেন, তাঁরা আরও ব্যাট করতে চান। প্রতিপক্ষ রাজি না হলে অপারগ আম্পায়ারেরাও। তাঁরাও খেলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
গোটা ঘটনা ঘটতে সময় লাগল মেরেকেটে মিনিট তিনেক। তবে এই একটা মুহূর্তই ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টের সারসংক্ষেপ পরিষ্কার করে দিল। হারের মুখ থেকে ড্র ছিনিয়ে নিল ভারত। যে দলকে নিয়ে চতুর্থ দিনের শুরুতে কেউ কোনও আশাই দেখতে পাননি, তাঁরাই পঞ্চম দিনে মাঠ ছাড়ল মাথা উঁচু করে। প্রমাণ করে দিল, হারার আগে হারতে নেই। খেলা যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকলে জয় আসবেই। তবে এ ক্ষেত্রে ড্র হলেও, রবি শাস্ত্রী ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় বলে দিলেন, ম্যাঞ্চেস্টারে ভারতের ‘নৈতিক জয়’ হয়েছে।
শুভমন, ওয়াশিংটন, জাডেজা— ভারতের এই ত্রয়ী নিশ্চিত হারের মুখ থেকে ড্র করলেন। বছর তিনেক আগে সিডনিতে এ ভাবেই হারা টেস্ট বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন হনুমা বিহারি এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তারও আগে, ২০০১-এ ইডেন গার্ডেন্সে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়ের সেই জুটি ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। তবে রবিবার ভারতের লড়াই সে সবের থেকে খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না। দ্বিতীয় ইনিংসে কোনও দল ১৪৩ ওভার ব্যাট করে ম্যাচ ড্র করছে, এই উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে নেই। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা যুগে, যেখানে লাল বলের ক্রিকেটটাই ভুলতে বসেছেন অধিকাংশ ক্রিকেটার। এই নিয়ে একটি সিরিজ়ের চারটি টেস্টেরই ফয়সালা হল পঞ্চম দিনে, যা আর এক বিরল দৃষ্টান্ত।
শনিবার শুভমন গিল এবং কেএল রাহুল মিলে ৬২ ওভার খেলেছিলেন ঠিকই। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে নতুন দিন সব সময় নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। ফলে শুভমন-রাহুলের সামনেও শুরুর কয়েকটা ওভার সামলে দেওয়ার কাজ ছিল।
পঞ্চম দিন লিয়াম ডসনকে প্রথম ওভার বল করতে দেখে অবাক হয়ে যান অনেকে। কারণ মেঘলা আকাশের নীচে কোনও পেসার শুরু করবেন এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় ওভারেই দ্বিধা কাটে। বল করতে আসেন বেন স্টোকস। চতুর্থ দিন ৬৩ ওভার খেলা হলেও পায়ে টান ধরার কারণে এক ওভারও বল করেননি স্টোকস। এ দিন আর নিজেকে আটকে রাখেননি।
কেন স্টোকস এই টেস্টে নিজের সেরা ছন্দে রয়েছেন, তা বোঝা যায় প্রথম ওভারেই। চতুর্থ দিন শুভমন, রাহুলকে কোনও ইংরেজ বোলার বেকায়দায় ফেলতে পারেননি। কিন্তু স্টোকস আসতেই ভারতের দুই ব্যাটার সতর্ক হয়ে যান। স্টোকস মূলত অফস্টাম্পের বাইরে বল করছিলেন, যা ঢুকে আসছিল ভেতরে। কোনও বল বুকের সমান আসছিল, আবার কোনওটি নিচু হয়ে যাচ্ছিল।
এ রকম একটি বলেই উইকেট খোয়ালেন রাহুল। স্টোকসের বল পিচের মাঝে পড়ে আচমকা নিচু হয়ে গেল। রাহুল ব্যাট নামানোর আগেই বল আছড়ে পড়ল প্যাডে। অভিজ্ঞ ব্যাটার বুঝে গিয়েছিলেন, ডিআরএস নিলে নষ্ট হবেই। তিনি ধীরপায়ে হাঁটা লাগালেন সাজঘরের দিকে। ইংল্যান্ড তখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে।
হিসেব মতো পাঁচে নামার কথা ছিল ঋষভ পন্থের। কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে তাঁকে অত আগে ব্যাট করতে পাঠাতে আগেই রাজি ছিল না দল। তা ছাড়া, পন্থ তখনও মাঠেই আসেননি। ফলে পাঁচে পাঠানো হয় ভরসাযোগ্য ওয়াশিংটন সুন্দরকে।
চলতি সিরিজ়ে গৌতম গম্ভীর, শুভমনেরা দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে দু’-একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার একটি হল ওয়াশিংটনকে খেলানো। তামিলনাড়ুর এই বোলারকে শুভমন যতই কম গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করুন, ওয়াশিংটন যখনই সুযোগ পেয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি অন্য জাতের ক্রিকেটার। লাল বলের ক্রিকেট তাঁর বরাবরই প্রিয়। কিন্তু রবিবার যে লড়াইটা করলেন, তা বহু দিন ভারতীয় ক্রিকেটের সমর্থকদের মনে থেকে যাবে।
ইংল্যান্ডের ইনিংসে ৬৮তম ওভারে বল করতে এসেছে পর পর দু’টি উইকেট নিয়েছিলেন ওয়াশিংটন। তার আগের টেস্টে তিনি চারটি উইকেট পেয়েছিলেন। তবু বোলিংয়ের সময় কোনও অজ্ঞাত কারণে ওয়াশিংটনের কথা কখনওই শুভমন ভাবেন না। অথচ ওয়াশিংটনের বোলিংয়ে এমন ব্যাপার রয়েছে যেটা বাকিদের নেই। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো আচমকা ব্যাটারদের বিভ্রান্ত করার মতো বল করতে পারেন। তবু তাঁকে উপেক্ষা করার চেষ্টা বার বারই হয়।
ওয়াশিংটন প্রতি বারই মুখ বুজে নিজের কাজটা করেন। রবিবারের ইনিংসটাও তেমনই। গোটা ইনিংসে একটাও সুযোগ দিলেন না বিপক্ষকে। তিনি ভালই জানতেন, একটা ভুল পদক্ষেপ মানে বিপদ অনিবার্য। তাই তাড়াহুড়ো বা ঝুঁকির রাস্তাতেই গেলেন না।
শুভমন ফিরে যাওয়ার পর সেই কাজটাই করলেন জাডেজাও। সাধারণত যে কোনও দলই চায় ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশন খেলাতে। কিন্তু রবিবার ভারতের ক্ষেত্রে দুই বাঁহাতিকে খেলানো কাজে দিল। ডানহাতি ব্যাটারদের ক্ষেত্রে যে বল পিচে পড়ে ভেতরে ঢুকছিল, সেটা হচ্ছিল না বাঁহাতিদের ক্ষেত্রে। ইংল্যান্ডের সব জোরে বোলারই ডানহাতি। ফলে পিচ থেকে সুবিধা পাচ্ছিলেন না কেউই।
একমাত্র স্পিনার লিয়াম ডসন বাঁহাতি। তবে তিনিও এমন বল করছিলেন না যা সুবিধা দিতে পারে ইংল্যান্ডকে। চা বিরতির পর স্টোকস ডেকে ডসনকে বুঝিয়ে দেন, কেন তাঁর উচিত বাঁহাতি ব্যাটারের অফ স্টাম্পের কাছে তৈরি হওয়া ‘রাফ’ (জুতোর আঘাতে তৈরি হওয়া এবড়োখেবড়ো জমি) কাজে লাগানো উচিত। কিন্তু ডসন সেটাই করতে পারলেন না।
চলতি সিরিজ়ে টানা চারটি অর্ধশতরানের পর অবশেষে শতরান করলেন জাডেজা। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার তিনিই। খেলছেনও সে রকমই। কখনও বোলিং, কখনও ব্যাটিং, দুই বিভাগেই নিজের দক্ষতা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। অথচ এ দিন প্রথম বলে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন স্লিপে। জো রুট সেই ক্যাচ না ফস্কালে এই ম্যাচ তখনই শেষ হয়ে যায়।
প্রশংসিত হবেন শুভমনও। এই সিরিজ়ে তাঁর অধিনায়কত্ব এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে যতই প্রশ্ন উঠুক, ব্যাটিং নিয়ে অন্তত কোনও সমালোচনা রাখার জায়গা দিচ্ছেন না তিনি। মাত্র ২৫ বছর বয়স। এর মধ্যে গ্যারি সোবার্স, ডন ব্র্যাডম্যান, সুনীল গাওস্করদের ছুঁয়ে ফেলেছেন বা পেরিয়ে গিয়েছেন। ব্যাট করতে নামলেই কোনও না কোনও নজির গড়ছেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নেতৃত্বের চাপ মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নামেন না। এ দিনও প্রবল চাপের মুখে শুভমনের লড়াকু শতরান না থাকলে অনেক আগেই ম্যাচ ভারতের হাত থেকে বেরিয়ে যায়।
সবশেষে স্টোকসের কথা বলতেই হবে। যতই আগেভাগে ম্যাচ করার প্রস্তাব দিয়ে জাডেজা এবং ওয়াশিংটনের শতরান কাড়ার চেষ্টা করুন, এই টেস্টে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পঞ্চম দিন প্রথম স্পেলে বোলিংয়ের সময় তাঁকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল শরীরের অস্বস্তি হচ্ছে। বার বার ডান কাঁধের নীচে হাত বুলোচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও পর পর কয়েক ওভার বল করে গেলেন। রাহুলের উইকেটও নিলেন। কিন্তু স্বাভাবিক ছন্দে দেখা গেল না। এই টেস্টে একমাত্র স্টোকসের বলেই বিব্রত হয়েছেন ভারতীয় ব্যাটারেরা। তবে শেষ দিনে সেই স্টোকসও বেরঙিন থেকে গেলেন।